সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমে, প্রাচ্যবিদ্যার অনুশীলন এবং ভারতীয়দের, ইংরাজী ভাষা ও পাশ্চাত্যবিদ্যায় আগ্রহ সঞ্চারিত করা- এই দুটি ধারার সঙ্গমস্থল এই সংস্কৃত কলেজ ও সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল

SCHOOL IS THE FOUNDATION OF MORAL ENLIGHTENMENT

Sanskrit collegiate school, a government bengali medium boys’ school, is run under Depatment of School Education, West Bengal and affiliated to Board of Secondary Education, West Bengal and Council of Higher Secondary Education, West Bengal, conducting classes from Pre Primary to XII.

ঊনবিংশ শতাব্দীতে জনজাগরণের জোয়ার যখন বাংলাকে প্লাবিত করছে সেই সময়েই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিক্ষা সংস্কৃতির মোহনারূপে চিহ্নিত হল গোলদীঘির পশ্চিম তীরস্থ সংস্কৃত কলেজ। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমে প্রাচ্যবিদ্যার অনুশীলন এবং ভারতীয়দের ইংরাজী ভাষা ও পাশ্চাত্যবিদ্যায় আগ্রহ সঞ্চারিত করা—প্রবহমান। এই দুটি ধারার সঙ্গমস্থল এই সংস্কৃত কলেজ।
সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল—এ বিষয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত হলে প্রথমেই এসে যায় সংস্কৃত কলেজ প্রসঙ্গ; সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার তাগিদে অনুভরের প্রেক্ষাপট বিচার করলে দেখা যায়—১৭৮১ খৃষ্টাব্দে কলকাতা মাদ্রাসার সূচনা, ১৭৯২ খৃষ্টাব্দে বারানসীতে স্থাপিত হল সংস্কৃত কলেজ। অতঃপর এল ১৮০০ খৃষ্টাব্দ। ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের বিদ্বজ্জনকে নিয়ে সংস্কৃত, বাংলা, আরবী, ফার্সীর অধ্যয়ন অধ্যাপনার স্থল হ’ল ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ। এই সময়েই লক্ষ্য করা গেল যে, পাশ্চাত্যের বিদগ্ধজন ভারতীয় শিক্ষা সংস্কৃতির প্রতি ক্রমশঃ আকৃষ্ট হচ্ছেন। প্রাচ্য-রসাস্বাদী লর্ড মিন্টো ১৮১১ সালের ৬ই মার্চ প্রশাসনের কাছে নবদ্বীপ ও ত্রিহুতে দুটি সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রস্তাব করলেন। যদিও প্রস্তাবটি কার্যে পরিণত হয়নি। এর কয়েক বৎসর পরে ১৮১৬ সাল নাগাদ ভারতীয় হিন্দু প্রধানেরা স্বজাতীয়দের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে তৎপর হলেন। এই তৎপরতা বাস্তবায়িত হল ১৮১৭ খৃষ্টাব্দের ২০শে জানুয়ারী হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
১৮২১ খৃষ্টাব্দে হোরেস হেম্যান উইলসন বারানসীর সংস্কৃত কলেজের আদর্শে কলকাতায় একটি সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। এই প্রস্তাবানুসারে ১৮২১ সালের ২৫শে আগষ্ট সংস্কৃত কলেজের জন্য বার্ষিক ২৫,০০০ টাকা অর্থ বরাদ্দ হয়। প্রতিষ্ঠিত হল এতেদ্দেশীয় প্রাচীনতম সরকারী পরিচালনাধীন সংস্কৃত কলেজ। তৎকালীন ঠিকানা ৬৬নং বহুবাজার স্ট্রীট। এর প্রায় তিন বৎসর পর ১৮২৪ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারী বর্তমান কলেজ ভবনের শিলান্যাস হয় ও ১৮২৬ সালের ১লা মে থেকে নবনির্মিত ভবনে পঠন পাঠন শুরু হয়। যদিও ৬৬নং বহুবাজার স্ট্রীট এর বাড়িতে ১৮২৪ সালের ১লা জানুয়ারি থেকেই সংস্কৃত কলেজের পাঠারম্ভ হয়। কলেজের প্রথমাবস্থায় ছাত্র ভর্তির ন্যূনতম বয়ঃসীমা ছিল বার বৎসর, পরবর্তীকালে এই নিয়ম সংশোধিত হওয়ায় আট বৎসর বয়স্ক ছাত্রই ভর্তির উপযোগী বলে বিবেচিত হয়। বয়ঃক্রম দেখেই বোঝা যায় বর্তমানে পৃথকীভূত স্কুল ও কলেজ শুরুতে একই প্রশাসনের অধীনে ছিল। তখন ৮ বৎসর বয়ঃপ্রাপ্ত যে কোন শিক্ষার্থীই কলেজের ছাত্র বলে গণ্য হত। বীরসিংহের বালক ঈশ্বরচন্দ্র নয় বৎসর বয়সেই সংস্কৃত কলেজে পাঠারম্ভ করেন। এই যুক্তিতেই সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলের প্রতিষ্ঠা কাল ১৮২৪ খৃষ্টাব্দ বলে বিবেচিত হয়। সংস্কৃত পাঠের পাশাপাশি এখানে অন্যান্য বিষয়েও শিক্ষাদান করা হত ।
প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই গ্রন্থাগার ছিল অপরিহার্য অঙ্গ। প্রথমে গ্রন্থাগারিক ছিলেন লক্ষ্মীনারায়ণ ন্যায়ালঙ্কার। ১৮২৬ সাল থেকে ভাস্করাচার্যের লীলাবতী ও বীজগণিত পড়ানো শুরু হয়। অধ্যাপক ছিলেন যোগধ্যান মিশ্র ও প্রিয়নাথ সিদ্ধান্তপঞ্চানন। ঐ বৎসরেই কলেজে অল্প কয়েকজন ছাত্রকে নিয়ে আয়ুর্বেদ পড়ানোর জন্য বৈদ্যক শ্রেণী খোলা হয়। পরবর্তীকালে ১৮৬৫ সালে কলকাতায় মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সংস্কৃত কলেজে ঐ বিভাগের পঠন পাঠন বন্ধ হয়ে যায় এবং কলেজের বৈদ্যক শ্রেণীর অধ্যাপক মধুসূদন গুপ্ত মেডিকেল কলেজে সহকারী অধ্যাপকরূপে নিযুক্ত হন। ১৮৩৫ থেকে ১৮৪২ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত এই কয় বৎসর বাদ দিলে ইংরাজী বিষয়ের পঠন পাঠন এখানে নিয়মিত
হত।
১৮৩৮ সালে ছাত্রদের পাঠ্য তালিকায় বাংলামাধ্যমে পাটিগণিত ও পদার্থবিদ্যা বিষয় দুটি স্থান লাভ করে। বিষয় শিক্ষক ছিলেন নন্দকুমার চক্রবর্তী। ১৮৪২ সালে পুরাবৃত্ত নামে একটি নতুন শ্রেণী খোলা হয়। অধ্যাপক নিযুক্ত হন কমলাকান্ত বিদ্যালঙ্কার।
ঊনবিংশ শতকের আলোকদিশারী সূর্য তখন মধ্যগগনে বিরাজমান। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষরূপে যোগদান করলেন বিদ্যাসাগর উপাধিধারী ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। নতুন দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে সংস্কৃত কলেজের পঠন পাঠনের সংস্কারে তিনি প্রয়াসী হলেন। ব্রাহ্মণেতর শ্রেণীর ছাত্ররা তাঁরই প্রচেষ্টায় সংস্কৃত কলেজে ভর্তির সুযোগ পেল। এই সময়েই প্রতিষ্ঠিত হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। সামগ্রিকভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন পাঠনে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য তৎপর হলেন সংস্কৃত কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ। তাঁর প্রচেষ্টায় সংস্কৃত কলেজ থেকে স্কুল বিভাগ পৃথক হল। নামকরণ হল ‘সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল’। পৃথক প্রধান শিক্ষক পদ সৃষ্টি হল। অধ্যক্ষের প্রস্তাবানুসারে প্রথম প্রধান শিক্ষকরূপে নিযুক্ত হলেন প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী। প্রধান শিক্ষকের পদে প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারীর নাম প্রস্তাব ক’রে ১৮৫৭ সালের ৮ই এপ্রিল অধ্যক্ষ ই. বি. কাওয়েল ডি. পি. ইয়ং গর্ডনকে একটি চিঠি দেন। সেই প্রস্তাবপত্রে তিনি লেখেন—”Baboo Prasanna Cumar Sarbadhikary whom I have proposed for the Head Teachership is certainly every way qualified for the post and I really think that the place would not be filled up by a better man. His qualification in English are very superior. In 1848 he stood first in the list of scholars of all colleges in Bengal.

১৮৫৭ সালের ১লা মার্চ থেকে ১৮৬৪ সালের ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে বৃত ছিলেন। এই সময়েই প্রাথমিক স্তরে ইংরাজী পঠন পাঠন শুরু হয়। শিক্ষকরূপে নিযুক্ত হন হরিনাথ শর্মা। এর আগে পর্যন্ত কেবল উচ্চ শ্রেণীতেই ইংরাজী পড়ানো হত। পরবর্তী প্রধান শিক্ষক পদে নিযুক্ত হন স্কুলেরই সেকেণ্ড মাষ্টার তারিণীচরণ চট্টোপাধ্যায়। এই ভাবেই বাংলার বহু কৃতি পুরুষের আসা যাওয়ার মধ্যে দিয়ে সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল দীর্ঘ 200 বৎসর অতিক্রম করেও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর। বরেণ্য ছাত্রদের তালিকায় ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিবনাথ শাস্ত্রী, শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ, কবি বিষ্ণু দে, শিল্পী বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়। সংস্কৃত কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ ডঃ দিলীপ কাঞ্জিলাল, পূর্বতন অধ্যক্ষ বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য আমাদের বিদ্যালয়েরই প্রাক্তন ছাত্র। এছাড়া দেশে বিদেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিষ্ঠিত। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করতে হয় পরাধীন বাংলার সেই তেজস্বী পুরুষ যিনি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, যাঁর কন্যা ছিলেন
স্বাধীনতা আন্দোলনের নেত্রী বীণা দাস (পরবর্তীকালে বীণা ভৌমিক), সেই বেণীমাধব দাস আমাদের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন।

Scroll to Top